- Iqbal Hussein Baltu

 Iqbal Hussein Baltu

ধর্ম দিলো পূর্ণতা, পশু হলো স্বাধীন চেতা।


বাউল মতবাদ বা বাউল দর্শন

হারাম মতাদর্শের মধ্যে আরেকটি মতাদর্শ হলো বাউল দর্শন। এটিও একটি হারাম মতবাদ, সুতরাং কোনো মুসলমানের জন্য এ মতবাদে বিশ্বাসী হওয়া বৈধ নয়। আর যারা এ মতবাদে পুরোপুরি বিশ্বাসী তারা মুমিন নয়। এ দেশের বুদ্ধিজিবী এবং আলেম সমাজ বহু আগে থেকেই এমতাদর্শ সম্পর্কে মুসলমানদেরকে সাবধান করেছেন। আমরা এখানে পাঠকদের সামনে সংক্ষেপে তার কিছু উপস্থাপন করছি।

বাউল পরিচিতি:
বাউল শব্দের উৎপত্তি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতদ্বন্দ্ব রয়েছে। কারও মতে বাউল শব্দটি ‘বাতুল’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। তাদের মতে ‘বাউল’ শব্দটি আসলে ‘বাতুল’ শব্দের অপভ্রংশরূপ।‘বাতুল’ মানে পাগল, সুতরাং বাউল সম্প্রদায় মানে পাগলের দল। আবার কারও মতে বাউল্যা....বাউলা.....বাউল....অর্থাৎ বাউল শব্দটি বাউলা শব্দের অপভ্রংশ।
আবার কারও মতে বাউল শব্দটি আরবি বাওয়াল শব্দের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। তারা বাউল শব্দটিকে আউলিয়া শব্দের বিকৃতরূপ বলে উল্লেখ করেছেন।
বাউলরা সর্বদা আত্মগোপনশীল, ভাবের ঘোরে অন্যমনস্ক। সাংসারিক ভোগ-বিলাসের প্রতি উদাসীন। তাদের কোনো সামাজিক মর্যাদানেই। তারা গেরুয়াধারী, আত্মভোলা, ঘরছাড়া, বৈরাগ্যপন্থী। তারা গান গেয়ে মনের মানুষের সন্ধান করে। বাউলদের বাহ্যিক পরিচয়ে বলা হয় যে, বাউল মাত্র গোঁফ-দাঁড়ি, বাবরী অথবা চূড়াবাঁধা মাথার চুল, ডান হাতে একতারা, বাম হাতে বাঁয়ার ওপর বাঁয়া বাঁধা থাকে কোমরের সঙ্গে। কেউ কেউ পায়ে নূপুর বাঁধে, গলায় রুদ্রাক্ষ-প্রবাল পদ্মবিজের মালা, কাঁধে ভিক্ষার ঝুলি, কোমর দুলিয়ে দেহ ঘুরিয়ে নাচে। তারা ঊর্ধমুখি হয়ে গান গায়, উদাসভাবে গ্রামে-গঞ্জে মাঠে-ঘাটে বিচরণ করে।
বিখ্যাত লোক সংগীত বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন (১৯০৪-১৯৮৭) বাউল পরিচয় প্রসঙ্গে বলেন, ‘অজানাকে জানবার উদ্দেশ্যে যারা সংসারধর্ম জলাঞ্জলি দেয় তারাই বাউল’।
ড. এনামুল হক উল্লেখ করেন যে, বাউল সম্প্রদায়ের নাম বাউলরা নিজেরা গ্রহণ করেননি। সাধারনত বাউল বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে সমাজ তাদেরকে এ নাম দিয়েছে।

বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব:

বাউল মতবাদের উদ্ভব সম্বন্ধে নানা মনীষীর নানা অভিমত রয়েছে। আমরা এখানে পাঠকদের সামনে তার সংক্ষিপ্ত রূপ পেশ করছি:

ক) মুহাম্মদ আব্দুল হাই ও আহমদ শরীফের মতে ‘এক কালে বাংলায় এই নাথ পন্থা ও সাহজিয়া মতের প্রাদূভাব ছিল। এ দু’টি সম্প্রদায়ের লোক এক সময় ইসলামে ও বৈষ্ণব ধর্মে দিক্ষিত হয়; কিন্তু বদ্ধমূল পুরাণো বিশ্বাস সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও তারা নিজেদের পুরানো প্রথার ধর্ম সাধন করে চলে। তারই ফলে হিন্দু মুসলমানের সমবায়ে বাউল মতের উদ্ভব হয়েছে।

খ) অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য উল্লেখ করেন যে, মুসলমান মাদব বিবি ও আউল চাঁদই এ মতের প্রবর্তক এবং মাদব বিবির শিষ্য নিত্যানন্দ পুত্র বীরভদ্রই বাউল মত এ বাংলায় জনপ্রিয় করে তোলেন।

গ) ওয়াকিল আহমদ বলেন, ‘উদারপন্থী ও যোগসাধক বৈষ্ণব সাহজিয়ার সঙ্গে ভ্রাম্যমান গোপনচারী এক শ্রেণীর মুসলমান ফকীর সম্প্রদায়ের মিলন মিশ্রণে বাউল নামধারী একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।
তিনি আরও বলেন, পলাশীর রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর যখন দ্বৈতশাসন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবাধ লুণ্ঠন নিপীড়ন চরম রূপ ধারণ করে সমাজকে আসহনীয় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়; তখনই সমাজের নীচুতলার হিন্দু ও ফকীর রূপী মুসলমানের মিলন সম্ভব হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে ফকীর সন্নাসীর মিলন এ সময় দেখা যায়। সুতরাং আঠোরো শতকের মধ্যভাগ বাউল সম্প্রদায়ের আবির্ভাব কাল বলে চিহ্নিত করা যায়।

বাউলদের ধর্ম বিশ্বাস
বাউল ধর্ম একটি সমন্বয় মূলক ধর্ম। বাউল সম্প্রদায়ের কোনো লিখিত ধর্মগ্রন্থ নেই। তাই তারা তাদের ধর্মের দার্শনিক পরিচয়ও দিতে পারে না। আমরা এখানে পাঠকদের সমনে বাউল গবেষকদের বাউল ধর্ম সংক্রান্ত অভিমত পেশ করছি।
আহমদ আব্দুল হাই ও ড. আহমদ শরীফের মতে ‘বাউলরা গুরুবাদী মানব ধর্মে বিশ্বাস করে। এ ধর্মের মূল সাধন পদ্ধতি তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের ওপর প্রতিষ্টিত। বাউল ধর্মের ওপর শিবশক্তিবাদ, রামকৃষ্ণবাদ, বৈষ্ণব সাহজিয়াবাদ সূফীদর্শন ও তত্ত্ব, গৈড়ের বৈষ্ণব ধর্ম তত্ত্ব প্রভৃতির প্রভাব রয়েছে। বাউল ধর্মের সঙ্গে কতকগুলো নিজস্ব বৈশিষ্টের ইহা একটি বিশেষ ধর্মরূপে গঠিত হয়েছে।

ড. আনিসুজ্জমান বাউল ধর্ম বিষয়ে বলেন,‘বাউল ধর্মমতের সঙ্গে অন্য কোনো প্রতিষ্টিত ধর্ম তত্ত্বের যেমন: ইসলাম হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের অন্তর্ভূক্ত করে দেখার চেষ্টা করা ভ্রান্তিকর মাত্র।
মুহাম্মদ আব্দুল জলিলের মতে ‘বাউল ধর্ম হচ্ছে বাংলার একটি উপধর্ম। যে ধর্ম বিশ্বাসের ওপর বৌদ্ধপূর্ব লোকায়ত ধর্ম, সাংখা, যোগ-সাধনা, বৌদ্ধ সাহজিয়ামত তন্ত্র, বৈষ্ণব রসবাদ, ইসলামী সূফীবাদ, প্রভৃতি মতবাদের প্রভাব পড়েছে’।

বাউল ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য সমূহ
বাউলদের নিজস্ব কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ নেই। তাই তাদের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বিভিন্ন গবেষকদের গবেষণা এবং তাদের রচিত গানের আলাকে আলোচনা করতে হয়। আমরা এখানে বিভিন্ন গবেষক ও মনীষীর দৃষ্টিতে সংক্ষেপে বাউল ধর্মের বৈশিষ্ট সমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
১. ওয়াকিল আহমদের মতে “বাউলরা কোনো প্রচলিত ধর্মীয় অনুশাসন বিশ্বাস করে না। তারা ইসলামী শরীয়ত হিন্দু ধর্মীয় বিধান ও সমাজ নির্দেশিত জাত-পাত মানে না। প্রচলিত ধর্ম মত ও সমাজ নির্দেশিত পথের বিরোধিতা করেই বাউলরা নিজেদের ভিন্ন জীবন দর্শন গড়ে তুলেছে।”
২. বাউলরা গুরুবাদী সম্প্রদায়। গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে বাউল সাধনায় লিপ্ত হতে হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে মানব দেহের মাঝে বিরাজ করে পরম পুরুষ; যা তাদের পরিভাষায় রসের মানুষ, অচল মানুষ, অধর মানুষ, ভাবের মানুষ, মনের মানুষ, অচিন পাখি, মন-মনুয়া বা সাঁই নিরঞ্জন। তাদের মতে গুরুবাদী সম্প্রদায়ে গুরুই সকল শক্তির উৎস।

৩. বাউলরা লৌকিক ধর্মের অনুসারী, উপাসক সম্প্রদায়। তাই তাদের মূল দর্শন ধর্ম ভিত্তিক। বাউলরা আধ্যাত্মবাদী হওয়ায় অর্ন্তমূখী ভাববাদী চেতনা লালন করে। বাউল দর্শনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ইচ্ছা শক্তিকে যাগ্রত করা।

৪. বাউল দর্শনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, কামকে নিয়ন্ত্রিত করা ও ঊর্ধ্ববাহু করা। তারা কামকে নিয়ন্ত্রিত করা বলতে তাকে নির্দিষ্ট চকে নিয়ন্ত্রন বা পরিচালনা করা বুঝায়। তাদের মতে দেহ একটি জটিল যন্ত্র। এই জন্ত্রের অভ্যন্তরে জটিল প্রতিক্রিয়ায়র মাধ্যমে যৌন কামনার উদ্ভব ক্ষেত্র দেখা যায়। বাউলদের প্রধান সাধনা হলো কাম শক্তিকে ঊর্ধ্বগতি করা। বাউলরা বিশ্বাস করে পরিদৃশ্যমান জগতের মনকে আকৃষ্টকারী এমন চাঞ্চল্য হতে মনকে সংযত করা ও সকল ইন্দ্রিয়ের রোধ করা আবশ্যক। ইন্দ্রিয়কে রোধ করাই হলো বাউল সাধনা। একাগ্রতা না হইলে সাধনা সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়।

৫. বাউল দর্শনের আর একটি প্রধান দিক হচ্ছে যৌনাচারে স্বাধীনতা। কেননা বাউল সাধনায় নারীকে সাধনার যন্ত্র রূপে ব্যবহার করা হয়। তাই সাধনা সঙ্গিনী হিসেবে নারীর সংসর্গ এবং যোগ সাধনার অঙ্গ হিসেবে নারী সম্ভোগ বাউল ধর্মে স্বীকৃত। এ প্রসঙ্গে মনসুর উদ্দিন বলেন, “এই সাধনায় সিদ্ধি লাভের প্রধান উপায় হইতেছে নারী সাধিকা। নারী সাধিকা ব্যতিরেকে বাউলদের সাধনা চলিতে পারে না। ...বাউলদের ধারণা নারী হইতে জগত সৃষ্টি। নারী ব্যতিরেকে জগত চলিতে পারে না। নারী রহস্যময়ী। তাহার রহস্য উৎঘাটন বাউলদের একটি বিশিষ্ট সাধন পদ্ধতি”।

৬.বাউলরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। পুনর্জন্মের ফেরে পড়ে মানুষকে দুনিয়াতে অবস্থান করতে হয়। তাই লালন সাঁই বলেন,“পিতার বীজে পুত্রের সৃজন/তাইতে পিতার পুনরজনম।”

আল্লাহ ও রাসূল সম্পর্কে বাউলদের বিশ্বাস
বাউলরা তাদের গানে আল্লাহ ও রাসূল শব্দ দুটি উল্লেখ করলেও তারা আসলে আল্লাহ ও রাসূল সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে না। তাদের মতে মুরশিদ রাসূল ও আল্লাহ অভিন্ন সত্তা। এমন কি আদমও আল্লাহ। এ প্রসঙ্গে তাদের নিন্মোক্ত গানগুলো প্রনিধান যোগ্য:
১. মুর্শিদের চরন সুধা/পান করিলে যাবে ক্ষুধা/করো নারে দিলে দ্বিধা-যেহি মুর্শিদ সেই খোদা/বোঝ অলিয়স মরশেদা আয়াতে লেখা কোরানেতে।
২. যেহি মুর্শিদ সেইতো রাছুল/ইহাতে নেই কোনো ভুল/খোদাও সে হয়;/ লালন কয় না এমন কথা/কোরানেতে কয়।
৩. আপন ছুরাতে আদম গঠলেন দয়াময়/তা নইলে কি ফেরেশতারে সেজদা দিতে কয়।/আল্লাহ আদম না হইলে/পাপ হইত সেজদা দিলে/ শেরেকী যারে বলে/এ দীন দুনিয়ায়।
৪. কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-কুরআন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও পিএইচডি গবেষক জনাব, রাশেদুজ্জামানের এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ১৬ ডিসেম্বর ২০১০খৃ. তারিখে, আপনাদের সমাজে গুরুর আবস্থান কোথায়? এমন এক প্রশ্নের জবাবে লালন সাইয়ের মাজারের খাদিম ফকির মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘যে গুরু সেই মুর্শিদ সেই রাসূল এবং সেই খোদা’।
আমাদের ধারণায় বাউলদের এরূপ বিশ্বাসে খ্রিস্টানদের তৃত্ত্ববাদের প্রভাব রয়েছে। খ্রিস্টানরা ঈসাকে (আ.) আল্লাহর অভিন্ন সত্ত্বা; আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করেছে। আর এ দাবির জন্য আল্লাহ তাদেরকে কাফের বলে ঘোষণা করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
{لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ قُلْ فَمَنْ يَمْلِكُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ أَنْ يُهْلِكَ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا} [المائدة: ১৭]
‘অবশ্যই তারা কুফরী করেছে যারা বলে ‘নিশ্চয় মারইয়াম পুত্র মাসীহই আল্লাহ’। বল, যদি আল্লাহ ধ্বংস করতে চান মারইয়াম পুত্র মাসীহকে ও তার মাকে এবং যমীনে যারা আছে তাদের সকলকে ‘তাহলে কে আল্লাহর বিপক্ষে কোনো কিছুর ক্ষমতা রাখে?’।
{لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ ثَالِثُ ثَلَاثَةٍ وَمَا مِنْ إِلَهٍ إِلَّا إِلَهٌ وَاحِدٌ وَإِنْ لَمْ يَنْتَهُوا عَمَّا يَقُولُونَ لَيَمَسَّنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ } [المائدة: ৭৩]
‘অবশ্যই তারা কুফরী করেছে, যারা বলে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তিন জনের তৃতীয়জন’। যদিও এক ইলাহ ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। আর যদি তারা যা বলছে, তা থেকে বিরত না হয়, তবে অবশ্যই তাদের মধ্য থেকে কাফিরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আজাব স্পর্শ করবে’।

বাউলরাও খ্রিস্টানদের এ বিশ্বাসের কুপ্রভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর অভিন্ন সত্ত্বা বলে দাবি করেছে। সুধু তাই নয়; তারা আদমকেও (আ.) আল্লাহর অভিন্ন সত্ত্বা বলে দাবি করেছে। বিস্ময়কর ব্যপার হলো; তারা এসব কথা কুরআনে আছে বলেও মিথ্যা দাবি করেছে। সুতরাং যারা এধরনের বিশ্বাস রাখে তারাও এ বিশ্বাসজনিত কারনে কাফের হবারই কথা।

পবিত্র কুরআন সম্পর্কে বাউলদের বিশ্বাস
বাউলদের বিভিন্ন গান দেখে মনে হয় তারা পবিত্র কুরআনের প্রতি আস্থাশীল। তারা নিজেরা কুরআন মানে এবং অন্যদেরকেও কুরআন মানতে আহ্বান জানায়। এ প্রসঙ্গে তাদের নিম্নোক্ত গানগুলো প্রনিধানযোগ্য:

১. মানো ভাই খোদার বিধান,পড়ো কোরান/এই ভাবে দিন যাবে না।
২. আল্লা মানো কোরান মানো/ওরে বান্দা গুনাহগার/পাইতে যদি চাও সাফায়াত/ দ্বীনের নবী মোস্তাফার।
৩. পড়ো খোদার কালাম পড়ো/ধরো নবীর তরীক ধরো।
উপর্যূক্ত গানগুলো থেকে কুরআন সম্বন্ধে তাদের ধারণা সঠিক বলে মনে হলেও অপর একটি গান থেকে কুরআন সম্পর্কে তাদের ধারণার বিকৃত ও বিভ্রান্ত বলে মনে হয়। গানটি নিম্নরূপ:

১. কি কালাম পাঠাইলেন আমার সাঁই দয়াময়/এক এক দেশে এক এক বাণী কোন খোদায় পাঠায়?/.... যদি একই খোদার হয় বর্ণনা/তাতে তো ভিন্ন থাকে না/মানুষের সব রচনা/তাইতে ভিন্ন হয়।
তাদের এ গান থেকে মনে হয় পবিত্র কুরআন আল্লাহর কালাম হবার ব্যপারে তাদের সন্দেহ রয়েছে। তারা কুরআনকে মানুষের কালাম বলে মনে করে। তারা আরও মনে করে যে, পবিত্র কুরআনে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রয়েছে। নিঃসন্দেহে এ ধরণের বিশ্বাস একটি কুফরি বিশ্বাস। অতীতের আল কুরআন অবিশ্বসীরাও পবিত্র কুরআনের কোথাও পরস্পর বিরোধী বক্তব্য বা বৈপরীত্য দেখতে পায়নি। তাই আল্লাহ তাআলা বলেন,
{أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا } [النساء: ৮২]
তারা কি কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হত, তবে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেত।

ইসলামী শরীত সম্পর্কে বাউলদের বিশ্বাস
বাউলরা ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে মারাত্মক ভ্রান্ত বিশ্বাসের অধিকারী। তারা ইসলামী শারীয়াত বলেতে সারা বিশ্বের মুসলমানরা যা বুঝে তারা তা বুঝতে চায় না। তারা মনে করে সালাত সাওম যাকাত হজ্জ আদায় করা এবং হালাল পরিহার করে হালাল অবলম্বন করাতে ইসলামী শরীয়ত মানা হয় না, বরং ইসলামী শরীয়ত মানতে হয় অন্য ভাবে। যার বিবরণ তারা দেয় নি। এ প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য নিম্নরূপ:

১. নামাজ রোজা হজ্জ,কলমা জাকাত/তাই করিলে কয় শরীয়ত শরা অনুসারে/আমি ভাবে বুঝতে পাই/এসব আসল শরীয়ত নয়/আরও কিছু অর্থ থাকতে পারে।
বাউলরা আরও মনে করে যে, শরীয়ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসলাম কায়েম হয় না, বরং নামাজ রোজা হজ্জ জাকাত ইত্যাদি বাদ দিয়ে তাদের তথাকথিত ধারণা অনুযায়ী আধ্যত্মবাদ অনুসরণ করলেই ইসলাম কায়েম হয়।

২. ইসলাম কায়েম হয় যদি শরায়/কি জন্যে নবীজি রহে/পনের বছর হেরা গুহায়?/পঞ্চবেনায় শরা জারী মৌলভীদের তম্বীভারি/নবীজি কি সাধ করি নবুয়তী পায়।
এ কারণেই বাউলরা ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান পালন করে না। নামায রোজা ইত্যাদির ধারধারে না। ড. আবুল আহসান চৌধুরী বলেন,“বাউল সম্প্রদায় ইসলামী শরীআত প্রবর্তিত নামাজ অস্বীকার করে। মসজিদে কখনও যায় না। রোযা রাখে না। হজ্জ ও যাকাতের বিধানের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা দেখতে পাওয়া যায় না। গাঁজা সেবসনকে অনেকে সাধনার অঙ্গ মনে করে।”
তাদের এ সব বক্তব্য ও বিশ্বাস যে কুফরী বক্তব এবং কুফরী বিশ্বাস তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কেউ কি ইসলামী শরীয়ত অস্বীকার করেও মুমিন থাকতে পারে?

ইসলামী পণ্ডিত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বাউল বিরোধী প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য
উনবিংশ শতাব্দির শুরুতে ফকীর লালন সাঁই-এর মাধ্যমে বাউল মতাদর্শের উৎকর্ষ সাধিত হলে; তখন থেকেই এ দেশের হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজনেরা বাউল মতবাদ প্রসঙ্গে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। তারা জানান বাউল মতবাদ ইসলাম হিন্দু খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শ ও শিক্ষার সঙ্গে সাঙ্ঘর্ষিক একটি মতবাদ। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম হাজী শরীয়তুল্লাহ(১৭৮০-১৮৪৯ খৃ.) ফরায়েজী আন্দোলনের মাধ্যমে প্রচলিত অনৈসলামিক কার্যকালাপ ও আচার অনুষ্ঠান দূর করার উদ্যোগ গ্রহন করেন। তিনি বাউল বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ আন্দোলন সৃষ্টি করেন। অতৎপর তার পুত্র পীর মুহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া (১৮১৯-১৮৬২ খৃ.) এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ফরায়েজী আন্দোলনের ফলে বাউলদের কার্যকালাপ বিশেষ বাধা প্রাপ্ত হয়।
হাজী শরীয়ত উল্লাহর মত তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১ খৃ.) এবং মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী(১৮০০-১৮৬২ খৃ.)প্রমুখ ব্যক্তিগণও বাউল মতবাদ বিরোধী প্রচারণা চালান। তৎকালীন সমযে বিভিন্ন বই পুস্তক ও প্রচার পত্র প্রকাশ ও বিলি করে বাউল মতবাদের বিরূদ্ধে আরও যারা অগ্রণী ভুমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে মাওলানা রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, তাঁর রচিত ‘বাউল ধ্বংশ ফতওয়া’(১৩৩২ বাং) মুহাম্মদ ওসমান খান রচিত ‘হেদায়েতুর ফাছেকীন’ (১৮৯৭ খৃ.) কাজী কেরামত উল্লা ও মুন্সী গোলাম কিবরিয়া প্রণীত ‘উচিত কথা’ (১২৯৬ বাং) মাওলানা ফজলুর রহমান ‘ভণ্ড ফকীর’ (১৩২১বাং) মাওলানা আবু জাফর রচিত ‘বাতেন ফিরকা’ উল্লেখযোগ্য। কুষ্টিয়ার বানিয়াপাড়া নিবাসী বিশিষ্ট সমাজসেবী মওলানা আফছার উদ্দিনও লালন পন্থী বাউলদের বিরূদ্ধে তৎপরতা চালিয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে তিনি প্রচারপত্র ও প্রবন্ধাবলী প্রকাশ করেছিলেন।

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগোর অধ্যাপক ড. আবুল আহসান চৌধুরী বলেন,“আঞ্জুমানে ওলামায় বাঙ্গলার পক্ষ থেকে মুসলমান সমাজের মধ্যে প্রবিষ্ট কুসংস্কার ও অনৈসলামিক কার্যকালাপ এবং বাউলদের বিরূদ্ধে জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে পুস্তকাকারে এক আবেদনপত্র প্রচার করেন। আবেদনকারীদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা মনিরুজ্জমান এছলামাবাদী, মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খান, মৌলভী খায়রুল আমান, শেরেবাংলা একেএম ফজলুল হক, মৌলবী নজম উদ্দিন, মৌলবী মুজিবুররহমান, মৌলবী কাজী নওয়াজ খোদা, মাওলানা ওবায়দুল হক, মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক, মাওলানা আব্দুল্লাহেল বাকী, মৌলবী মোহাম্মদ আব্বাছ আলী, ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ।”

বাউল দর্শন ও বাউল মতবাদ সম্পর্কে এদেশের বিশিষ্টজনেরা যে মতামত ব্যক্ত করেছেন আমরা এখানে সংক্ষেপে পাঠকদের সামনে তার কিছু পেশ করছি:
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাউল ধর্ম মত বিষয়ে বলেন, “ধর্মের আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক বড় একটা নেই। তারা কিন্তু মুখে ধর্মের আনুগত্য স্বীকার করে না। একদল ফকীর হয়তো নামাজ রোজা ইত্যাদি ইসলামের অবশ্যকরণীয় কোনো কাজেই করে না কিন্তু তাঁরা প্রকাশ করে না যে তাঁরা আল্লাহ ও রাসূলের বক্ত। তাঁরা বলেন, সাধারণ মুসলমান আছে শরীয়ত বা ধর্মের আচার নিয়ে আর, আমরা আছি মারেফাত বা ধর্মের অন্তরঙ্গ নিয়ে। এঁরা জিকরে মশগুল হন, মারেফতী গানে মাতোয়ারা হয়ে নাচেন। .....মৌলানা মৌলবীরা এঁদর বে-শরা ফকীর বলে নাম দেন। তাঁরা এঁদের ইসলামের গণ্ডীর বাইরে কাফির বলে ফতোয়া দেন। সত্যই দলিল প্রমাণে এই সমস্ত বে-শরা ফকীর ইসলামের গণ্ডর বাইরে পড়ে।”

ড. আনিসুজ্জমান বাউল মতাদর্শ সম্পর্কে বলেন,“বাউল ধর্মমতকে অন্য কোনো পতিষ্ঠিত ধর্মতত্ত্বের যেমন, ইসলাম, হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মের অন্তর্ভূক্ত করে দেখার চেষ্টা করা ভ্রান্তিকর মাত্র। হিন্দু সম্প্রদায় বাউলদেরকে তাদের সমাজ বহির্ভূত জ্ঞান করেই: বাউল (সংস্কৃত ‘বাতুল’ শব্দজাত) নাম অভিহিত করেছেন এবং মুসলমান সমাজ ও এঁদের নামকরণ করেছেন বে-শরা ফকীর বলে, অর্থাৎ এঁরা মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহন করেও শরীয়ত অনুযায়ী বিশ্বাস ও অচার ব্যবহারের পরিচয় দেন না।...যথার্থ ভাবে বিচার করতে গেলে বাউলদের মতবাদ আলোচনা না করাই উচিত। কেননা তাদের মতামত ও সাধন পদ্ধতি ইসলামে অনুমোদন যোগ্য নয়।”
অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ বলেন,“বাউল সম্প্রদায় ভাববিদ্রোহী। তাদেরকে বাংলাদেশের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে অশ্বীকার ও বর্জন করে সহজ সাধনায় ব্রতী হতে দেখা যায়। কোন ধর্মীয় বিধান তাদের পরিচালিত করেনি। হৃদয় তাদের পথ পরিচালক। বাউলরা আল-কুরআন, পুরান, বেদ, বাইবেল ইত্যাদি ধর্মীয় গ্রন্থে তাদের কোন বিশ্বাস ছিল না। যার কারণে বাউল ধর্ম এদেশে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসে এক মহাব্যাধি স্বরূপ আর্বিভূত হতে দেখা যায়।”

মোদ্দা কথা: বাউল মতবাদ তাদের ধর্মিয় বিশ্বিাস ও জীবনাচরণের কারণে এদেশের আলেম সমাজের কাছে দীর্ঘদিন হতে একটি কুফরী মতবাদ বলে পরিচিত হয়ে আসছে। সুতরাং এ মতবাদে বিশ্বাসী হওয়া কোনো মুসলমানের জন্য কিছুতেই বৈধ নয়।

লেখক:
অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

No comments:

Post a Comment

Pages