
শহীদ এমএ গফুর
---------------------------------------------
পাইকগাছা - কয়রার মাটি,
তোমার জন্ম-ই হয়েছে খাটি।
সংগ্রামী তুমি বায়ান্নের একুশে আর একাত্তরে ,
তোমারি স্মরণে বাংলার ললাটে আজ অশ্রু ঝরে।
ঐ সর্বহারা জামাল আর নকশাল,
কেড়ে নিলো গফুর রিয়াজ উদ্দিন কামাল।
দুঃখীনী মায়ের অশ্রু সিক্ত নয়ন,
গণমানুষের মনে থাকবে তোমারি বিচরণ।
-------------------------------------------------------
জন্ম:- ২৬ শে বৈশাখ ১৩৩২ ( বাংলা )
মৃত্যু :- ৬ জুন ১৯৭২ সন।
জন্মস্থান :- হরিনগর,পাইকগাছা- কয়রা,খুলনা।
শহীদস্মৃতি :- পাইকগাছা কয়রার কপোতাক্ষর তিন নদীর মোহনা শাহ্ পাড়া।
শিক্ষা জীবন:- কপিলমুনি প্রথমিক বিদ্যালয়,
আশাশুনির বুধাটায় হাইস্কুল এসএসসি,
পরবর্তীততে খুলনার ঐতিহ্যবাহী বিএল কলেজ। এইচএসসি ও বিএ।
রাজনীতি :- ছাত্র ইউনিয়ন ( ন্যাস ) পরবর্তীতে,
আওয়ামীলীগে যোগ দেন।
ভাষা আন্দোলন :-
৫২ ভাষা আন্দোলনে রাজপথে সংগ্রামী সৈনিক ছিলেন এমএ গফুর। ৫২ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের রক্তঝরার খবর খুলনায় এসে পৌঁছালে ২২ শে ফেব্রুয়ারি রাজপথে নেমে আসে ছাত্রসমাজ। সে দিন সমীর আহম্মদের নেতৃত্ব খুলনা মহানগরীর আহসান আহম্মদ রোডে আজাদ গ্রন্থাগারে বৈঠক করেণ ছাত্রসমাজ যাতে আন্দোলনকে আরোও বেগবান করা যায় সে লক্ষ্য ।
ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমএ গফুর, আবু মুহা: ফেরদৌস, এমএ বারী, নজরুল ইসলাম দাদূ, এস এম জলিল, জাহিদুল হক, তোফাজ্জেল হোসেন সহ আরোও অনেকেই। বৈঠকে কঠোর আন্দোলন করার সিন্ধান্ত নেয়া হয় এবং পরবর্তীতে এমএ গফুর আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
তিনি পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে পায়ে হেটে স্কুল- কলেজে ছাত্রদের বুঝাতে থাকেন। এই আন্দোলনে অনেকে জেল খাটেন। ভাষা আন্দোলনের অগ্র সেনানী নেতৃত্ব দানকারী শহীদ এমএ গফুর নিজের জীবনকে বাজী রেখ সেদিন খুলনার রাজ পথে মিছিলে মিছিলে শ্লোগানে শ্লোগানে করেছিল মুখরিত । আজ মহান ভাষা আন্দোলন ৬৪ বছর পরও এ ভাষা সৈনিকের নাম ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করা হোল না।
আওয়ামীলীগে যোগদান :-
খুলনার বিএল কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে আওয়ামীলীগে যোগদান করে ৬৯ এর গণ অভ্যূত্থানে ঝাপিয়ে পড়েন। তিনি ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু আস্তা ও বিশ্বাস অর্জন করে কাছের ও প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠেন।
নির্বাচন :-
১৯৭০ সনের নির্বাচনে তিনি পাইকগাছা, কয়রা ও আশাশুনি থেকে নির্বাচন করেন। খুলনা অঞ্চালকে পাকিস্তানের সাথে একীভূত কারী পাকিস্তানের সংসদের স্পিকার কিংবদন্তি রাজনৈতিক বীদ খান-এ-সবুর এর বিরুদ্ধে নির্বাচন করে এমএনএ নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধ :-
৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ঝাপিয়ে পড়েন। তিনি ৯নং সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। ৭১ মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শিবির গুলো বর্ণনাতীত দূরাবস্তা। সাধারণত এক হাটু কাদাজলে ডোবানো ট্রেনিং শিবির গুলোতে না ছিলো পর্যাপ্ত খানার ব্যবস্থা, না ছিলো বাসোপযোগী কোন ব্যবস্থা। দিনরাত খেটেও তারা পেট পুরে খেতে পাইনি।
আধেটা অবস্থায় তাদের দুঃসহ দিন যাপন করতে হয়েছে। সারা দিন- রাত দু' বেলা খিচুড়ি জুটে গেলেই সেই দিন সৌভাগ্য মনে করতো। পরিধানের লুঙ্গী গামছাও ছিলোনা এক ধরণের বিলাস। অনেক মুক্তিযুদ্ধা কেবল একটা হ্যাপ পেন্ট কিংবা এটা লুঙ্গী পরিধান করে ঘুরে বড়াতে দেখা যেত। মৌসুমের নির্বিচার বৃষ্টির ধারা তাদের কে সামান্যতম বিশ্রাম পর্যন্ত দিতে দিতো না।
হাটু কাদা মাটিতে মশার অত্যাচার নির্বিচারে সহ্য করে সারারাত দাড়িয়ে কাটাতে হতো তাদেকে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের নাকি নেতৃত্ব দানকারী বলে পরিচিতদের দেখা যেত কলকাতার অভিজাত এলাকার হোটেল- রেস্টুরেন্ট গুলোতে জমজমাট আড্ডায় ব্যস্ত। ৭১ এর সেই গভীর বর্ষণ মুখর দিনরাতে কলকাতার অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতে বসে গরম কফি কাপে চুমক দিতে গিয়ে হাটুতক ডুবন্ত কাদাজলে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শিবির গুলোতে অবস্থানরত হাজার হাজার তরুণের বেদনাহত চেহারাগুলো তারা একবারও দেখেছে কিনা তা আজও আমার জানতে ইচ্ছা করে।
আমার জানতে ইচ্ছা করে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের নাইট ক্লাব গুলোতে বীয়ার হুয়স্কি পানরত মুক্তিযুদ্ধের নাকি নেতৃত্ব দানকারী তাদের মনোমুকুরে একবারও ভেসে উঠেছে কি সেই গুলিবিদ্ধ কিশোর কাজলের কথা যে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত চিতকার করে বলেছিল 'জয় বাংলাা'। আমার জানতে ইচ্ছা করে আরও অনেক কিছু। এই ট্রেনিং শিবির গুলোতে আওয়ামীলীগের যে সকল নেতৃবৃন্দ গণের দেখা মিলতো বা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীতা এবং নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো ও তাদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তার মধ্যে তিনি এমএ গফুর সাহেব এক জন। এমএনএ আব্দুল গফুর সাহেব যথেষ্ট শ্রম দিয়েছেন এবং নিবেদিত চিত্তে মুক্তিযুদ্ধের সফলতা কামনা করেছে।
- ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল।
শোনাকথা :-
নানার বাড়ি বৃষ্টিপর নানার মুখে শুনেছি বাবর সাহেবের সাহসীকতার কথা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরত্ব গাথা যুদ্ধের কথা আর শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ভাষা সৈনিক গফুর সাহেবকে নির্মম ভাবে সে দিন যারা হত্যার করেছিলো সেই ক্লেশিত কথা । গফুর সাহেব কয়রা আমাদিয়া তেরো আয়লের বাধের নির্মাণকাজ পরিদর্শন করে পাইকগাছার উদ্দেশে রওনা দেন। গফুর সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো পার্শ্ববর্তী গ্রাম শাহ্পাড়া জনৈক মুক্তি যুদ্ধা তার বাড়ি ভোজনের দাওয়াত হয়, তিনি চাঁদখালী নোঙ্গর করে বন্ধুর বাড়ি ভোজন সারেন।
আবার রওনা দেন পাইকগাছা উদ্দেশে কিন্তু সেখান থেকে এক কি:মি: দূরত্বে কপোতাক্ষ নদের তিন নদীর মোহনা শাহ্পাড়ায় সর্বহারা নকশাল জামাল বাহিনী নির্মম ভাবে গফুর সাহেব ও তার সফর সঙ্গী রিয়াজ উদ্দিন ঢালি( চাদখালী) কামাল হোসেন ঢালি ( হড্ডি) কে হত্যা করে গাছে বেধে নদীতে ডুবিয়ে দেন। বলে ছিলেন নানা- মুক্তার সরদার। স্বাধীনতার এই ৪৫ বছর পর আজও আমার পেলাম না এই নির্মম ক্লেশিত হত্যাকান্ডের বিচার।
জবাব চাই-
যুদ্ধাপরাধ:-
৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষন,লুট- পাট ইত্যাদি সঙ্গে জড়িত ছিলো যে ৯৩ হাজার সৈন্য তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিৎ ছিলো। চিহ্নিত মূল অপরাধীদের স্পর্শ পর্যন্ত করতে ব্যর্থ হয়ে যারা ভারতের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাদের হাতে হস্তান্তর করার মধ্য দিয়ে লেগে পড়ে রাজাকার- আল বদর ধরার নামে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত জিঘাংসার কাজে।
৭২ এর ২৪ জানুয়ারি জারি করা হলো বাংলাদেশ দালাল আইন ( বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ),১৯৭২। এই আইনের আওতায় এনে সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা হয়। বঙ্গবন্ধু স্বয়ং ১৯৭৩ সনে ৩০শে নভেম্বর দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারধীন সকলকে সাধারণ ক্ষমা করে দেন। ৯৬ এ ক্ষমতা এসে নীরব ২০০৮ এ ক্ষমতা এসে একটি সম্পন্ন বিচার প্রক্রিয়াকে আবার নতুন ভাবে শুরু করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় কিছু ব্যক্তির বিচারের জন্য রাষ্ট্রীয় শতশত কোটি টাকা খচর করে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে তা জনগণের কাছে কতো টুকু গ্রহণ যোগ্যতা পেয়েছে?
অবশ্য আমরা চাই অপরাধীদের বিচার হোক। আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও পত্রপত্রিকার পাতায় পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধা ঠেলাগাড়ি ভ্যান চালায় পেটের দায়ে, এমনি ভীক্ষা করতে দেখা গেছে। যে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময় অর্জিত স্বাধীনতা তাদের নামটি এখনো পর্যন্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হলো না কেন এখানে স্বার্থ নেই সেই জন্য কি ?
ভারত:-
পাক বাহিনীকে সরিয়ে দিয়ে ৭১/৭২ এ বাংলা দখল করে ভারত। এই যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশ থেকে ৫০হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট পাট করে নেয় ভারতীয় বাহিনী কোন স্বার্থর জন্য সেদিন ছিলো নীরব? আজও পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলা হয় না। সে দিন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলে ছিলো ৯নং সক্টর কমান্ডার মেজর জলিল তার প্রতিদান স্বরূপ তার খেতাব থেকে করা হয় বঞ্চিত, করা হয় বন্ধি কার কি স্বার্থে জন্য এমন নিকৃষ্টতম কাজ করা হয়েছিল ?
বীরাঙ্গানা:-
স্বাধীনতার এতো বছর পরেও আজ বীরাঙ্গনাদের জন্য কি কি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে? বীরাঙ্গনারা কোথায় আছে কেমন আছে তাদের খবর কি কেহ রাখে? বীরাঙ্গনারা কলংকের বোঝা বইতে না পেরে প্রায় ৫০ হাজার হতভাগিনী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। বঙ্গজননী খেতাব প্রাপ্ত জাহানারা ইমামের প্রতি এতো দরদ কেন? ৭১ এ সরাসরি নির্যাতিত লক্ষ লক্ষ ভাগ্যবিড়ন্বিতার বেলায় দরদ ও বিবেক জাগ্রত হয় না কেন?
বিচার কি হবে:-
১৯৭০ সনে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু না থাকলে ধ্বস নামানো বিজয় কখন সম্ভব হতো না। মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ভূমিকা ছিলো ঐতিহাসিক ও অনন্যসাধারণ। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি পরিকল্পনা করুন বা নাই করুন তার বিশাল ভাবমূর্তি ছিলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চালিকা শক্তি। বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাট করে দেখার কোন অবকাশ নেই।
সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ব্যাপারে কোন বিবেকসম্পন্ন মানুষ দ্বিমত পোষন করতে পারেনা। দ্বিমত পোষনের কোন সুযোগ নাই। সঙ্গে সঙ্গে ন্যূনতম বিবেক সম্পূর্ণ মানুষকে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও দলীয় নেতাকর্মী দের হত্যা যেমন অপরাধ ঠিক তেমনি অপরাধ বাংলাদেশের যে কোন মানুষকে হত্য করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সংঘটিত ব্রাশ ফায়ারিং এর মাধ্যমে সাত ছাত্রের তাজা প্রাণ ঝরিয়ে দেওয়া, জাতীয় চার নেতার হত্যা, শোষিত মানুষের মুক্তির বেদীমূ্লে নিবেদিতপ্রাণ পাক হায়নাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা কমরেড শিরাজ শিকদার, জাসদের সহ সভাপতি, যশোরের মোশারফ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধা সিদ্দিক মাস্টার, আবুল কালাম আজাদ, হাদী, মন্টু, রোকন, খুলনার ভাষা সৈনিক মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক এমএ গফুর, সহ জাসদের হাজার হাজার নেতা কর্মী হত্যার বিচার হলো না কেন? এসকল হত্যাকান্ডের বিচার হবেনা কোন রাজনৈতিক স্বার্থ নিহিত নেই এ জন্য কি?
No comments:
Post a Comment