দাম্পত্য আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য -
আইনকে ব্যাপক ভাবে যানার পূর্বে তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে অবগতি লাভ করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা আইনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। উদ্দেশ্য পূরণের জন্য নীতিমালা নির্ধারণ করা হয় এবং নীতিমালার অধীনে আইনের নির্দেশাবলী ও ধারাসমূহ বিবৃত হয়।
যদি কোন ব্যক্তি উদ্দেশ্যকে না বুঝেই নির্দেশকে কার্যকর করে, তাহলে ছোট খাট সমস্যার ক্ষেত্রে এমন সব রায় দিয়ে বসার খুবই আশংকা রয়েছে যার ফলে আইনের মূল উদ্দেশ্য বিলীন হয়ে যায়। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগতি হবে না সে আইনের সঠিক ভাবধারা অনুযায়ী তার অনুসরণও করতে পারবে না। তবে যে এসব উদ্দেশ্য সামনে রেখে ইসলামে দাম্পত্য বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে আমরা প্রথমে সে গুলো আলোচনা করব।
নৈতিক চরিত্র ও সতীত্বের হেফাযত
ইসলামী দাম্পত্য আইনের প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্র ও নৈতিকতার হেফাযত। এই আইন জ্বেনা কে হারাম ঘোষণা করেছে এবং মানব জাতির উভয় শ্রেণীর স্বভাবগত সম্পর্কে এমন এক আইন কাঠামোর অধীন করে দেয়ার জন্য বাধ্য করেছে যা তাদের চরিত্রকে অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা থেকে এবং সমাজকে বিপর্যায়ের হাত থেকে রক্ষা করবে।
এই জন্য কুরআন মজিদে 'নিকাহ' শব্দে ইহসান শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে। 'হিসন' শব্দের অর্থ দুর্গ আর ইহসান শব্দের অর্থ হচ্ছে দুর্গে আবদ্ধ হওয়া। অতএব যে ব্যক্তি বিয়ে করে সে হচ্ছে মোহসিন। অর্থাৎ সে যেন একটি দুর্গ নিরমান করছে আর যে স্ত্রী লোককে বিয়ে করা হয় সে হচ্ছে মোহসিনা অর্থাৎ বিয়ের আকারে তার নিজের ও নিজ চরিত্রের হেফাযতের জন্য যে দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছে তাতে আশ্রয় গ্রহণ কারিণী।
এরূপ উদাহরণ পরিষ্কার বলে দিচ্ছে যে, চরিত্র ও সতীত্বের হেফাযত করাই হচ্ছে ইসলামে বিয়ের সর্বপ্রথম উদ্দেশ্য। আর দাম্পত্য আইনের প্রথম কাজ হচ্ছে এ দুর্গকে সুদৃঢ় করা যা বিয়ের আকারে চরিত্র ও সতীত্বের এ মহামূল্যবান বস্তুকে হেফাযত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
" এই মুহরিম স্ত্রী লোকদের ছাড়া অন্যসব মহিলা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে যেন তোমারা নিজেদের ধন- সম্পদের বিনিময়ে তাদের কে হাসিল করার আকাঙ্ক্ষা কর। তোমাদের কে বিবাহ- বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য এবং অবাধ যৌনচর্চার প্রতিরোধের জন্য এব্যবস্থা করা হয়েছে। অতএব তোমরা তাদের থেকে যে স্বাদ অস্বাদ করেছো তার বিনিময়ে চুক্তি অনুযায়ী তাদের মোহর পরিশোধ কর।" নিসা- ২৪
" অতএব তোমরা তাদের অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে তাদের বিবাহ কর এবং ন্যায় সঙ্গত পরিমাণে মোহর আদায় কর, যেন তারা সতীসাধ্বী হয়ে থাকে এবং প্রকাশে ও গোপনে জ্বেন করে না বেড়ায়"। নিছা-২৫
" আজ তোমাদর জন্য সমস্ত পবিত্র জিনিস হালাল করা হলো। আর ঈমানদার সতী নারী ও তোমাদের পূর্বেকার আহলে কিতাবদের সতী নারীদের তোমাদের জন্য হালাল করা হলো। তবে শর্ত হচ্ছে- তোমরা তাদেরকে মোহর প্রদানের বিনিময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ কর এবং প্রকাশ্যে অথবা গোপনে চুরি করে অবৈধ প্রমের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না"। মায়েদা-৫
এসব আয়াতের শব্দ ও অর্থ নিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে পুরুষ ও নারী দাম্পত্য সম্পর্কে মধ্যে ইহসান অর্থাৎ চরিত্রের ও সতীত্বে পূর্ণ হেফযাতই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা এমনি এক মহান উদ্দেশ্য যার জন্য অন্য যেকোন উদ্দেশ্যকে কুরবানি করা যেতে পারে। কিন্তু অন্য যে কোন উদ্দেশ্যের জন্য এ উদ্দেশ্যকে বিসর্জন দেওয়া যাবে না।
স্বামী - স্ত্রী কে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে তারা যেন আল্লাহুর নির্ধারীত সীমার মধ্যে অবস্থান করে তাদের স্বভাবসুলভ যৌন স্পৃহা পূর্ণ করে। কিন্তু যদি কোন বিয়ের বন্ধনে ( স্বামী- স্ত্রী মধ্যে ) এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যার দরুন আল্লাহু তাআলার নির্ধারিত সীমা লংঘিত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়, তাহলে এ বিয়ের বাহ্যিক বন্ধকে অটুট রাখার জন্য তার নির্ধারিত অন্যান্য সীমারেখা লংঘন করার পরিবর্তে বরং এগুলো হেফাযতের জন্য বিয়ের বন্ধকে ছিন্ন করে দেয়াই অধিক উত্তম।
এ জন্যই ঈলাকারীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা যেন চার মাসের অধিক সময় নিজেদের প্রতিজ্ঞার ওপর অবিচল না থাকে। যদি সে চার মাস অতিক্রমের পরও স্ত্রীর কাছে প্রত্যাবর্তন না করে তাহলে যে স্ত্রীর সাথে সে যৌন সম্পর্কে স্থাপনে অনিচ্ছু, তাকে বিয়ের বন্ধনে আটকে রাখার কোন অধিকার তার নেই। কেননা তার অবশ্যম্ভবী পরিমাণ এই দাড়াবে যে, স্ত্রী লোকটি তার প্রাকৃতিক দাবি পূরণের জন্য আল্লাহুর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করতে বাধ্য হবে।আল্লাহুর আইনে কোন অবস্থায় তা সহ্য করতে পারে না। অনুরূপ ভাবে যারা একাধিক মহিলাকে বিবাহ করে তাদের কঠোর ভাবে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে ঃ
" এক স্ত্রীকে একদিকে ঝুলিয়ে রেখে অপর স্ত্রীরের দিকে একেবারে ঝুকে পড় না"। নিছা-১২৯
এই নির্দেশেও উদ্দেশ্য হচ্ছে কোন স্ত্রী যেন এ অবস্থার প্রেক্ষিতে আল্লাহুর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করতে বাধ্য না হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে দাম্পত্য জীবনের বাহ্যিক বন্ধন অটুট রাখার পরিবর্তে তা ভেঙ্গে দেয়াই উত্তম। এর ফলে স্ত্রী লোকটি বন্ধন মুক্ত হয়ে তার পছন্দসই অন্যকে বিয়ে করার সুযোগ পাবে। এই একই উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে 'খোলা' করার ক্ষমতা ও দেওয়া হয়েছে।
কোন স্ত্রী লোকের এমন ব্যক্তির কাছে থাকা - যাকে সে আদৌ পছন্দ করে না অথবা যার কাছে সে মানসিক শান্তি পাইনা - এটা তাকে এমন অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করে যার ফলে আল্লাহুর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘিত হয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এধরণের স্ত্রীলোককে অধিকার দেয়া হয়েছে যে, সে মোহরের আকারে স্বামীর নিকট থেকে যে অর্থ পেয়ে ছিলো তা সম্পূর্ণটা অথবা কিছু কম বেশি তাকে ফেরত দিয়ে বিয়ের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে।
ইসলামী আইনে এধারা গুলো বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হবে। কিন্তু এখানে উল্লেখিত উদাহরণ সমূহ পেশ করে এই নিগূঢ় তত্ত্ব উৎঘাটন করাই উদ্দেশ্য যে, ইসলামী আইন চরিত্র ও সতীত্বের হেফাযত কে সব জিনিসের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে যদিও তা বিবাহ বন্ধনকে সম্ভব্য সকল উপয়ে সুদৃঢ় করার চেষ্টা করে।
কিন্তু সেখানে এ বন্ধন বহাল রাখলে চরিত্র ও সতীত্বের ওপর আঘাত আসার আশংকা দেখা দেয়, সেখানে এ মূল্যবান ঐশ্বর্যকে রক্ষকরা তাগিদেই বৈবাহিক বন্ধনের গিঠ খুলে দেয়াই সে জরুরী মনে করে। আইনের যে ধারাগুলো সামনে অগ্রসর হয়ে আলোচনা করা হবে তা অনুধাবন করার জন্য এবং সে গুলোকে আইনের স্পিরিট অনুযায়ী কার্যকর করার জন্য এই সূক্ষ্ম বিষয়টি ভালো ভাবে হৃদয়ংগম করা একান্ত প্রয়োজন।
সাইয়েদ মওদূদী

স্বামী- স্ত্রীর আধিকার।প্রসঙ্গ - নৈতিক চরিত্র ও সতীত্বের হেফাযত।
Share This
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment