১৯৬৯ এর ২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিপা’র উদ্যোগে আয়োজিত নূরখান কর্তৃক প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির উপর আলোচনা সভায় মেধাবী ছাত্রনেতা আবদুল মালেকের ঐতিহাসিক বক্তব্য যেন আজকে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। শহীদ আব্দুল মালেক ভাষন বাতিলের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে, সত্যিই এই প্রিয় নেতার বক্তব্যে কম্পন সৃষ্টির উপাদান ছিল বড়ই শক্তিশালী। তাঁর বক্তব্য ছিলো বলিষ্ঠ, যুক্তিপূর্ণ ও তেজদীপ্ত। শহীদ আবদুল মালেকের ক্ষুরধার যুক্তি ও বলিষ্ঠ বক্তব্য মিলনায়তনের সবাইকে মুগ্ধ করে। শ্রোতারা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষেই মত প্রকাশ করল।
পরবর্তীতে ১২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে আলোচনা জন্য শহীদ আবদুল মালেক ও তাঁর সাথীরা দাবি জানান। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা এটা সহ্য হলো না। ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তরা লাঠি, লোহার রড প্রভৃতি দিয়ে রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী) ময়দানে আবদুল মালেক এর উপর পৈশাচিক হামলা চালায়। তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় দুর্বৃত্তরা তাঁকে সেখানে রেখে চলে গেলে আশপাশের লোকেরা তাঁকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। ১৫ আগষ্ট তার বহু কাংখিত শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে মহান মাবুদের দরবারে পাড়ি জমান, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেদিন কি বলেছিলেন তিনি? যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সেরা ছাত্রনেতাকে লোহার রড-কিরিচ আর লাঠি দিেিয় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল? হ্যাঁ, সেদিন মেধাবী ছাত্রনেতা আবদুল মালেকের ক্ষুরধার যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য বাম-রামদের ষড়যন্ত্রের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মেধা এবং নৈতিকতার সমন্বয় ব্যতিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে না। আজকে সমাজের অপরাধ, যুব সমাজের চরিত্র বিধ্বংসী কার্যক্রম তারই সাক্ষ্য প্রমাণ করে।
তাই আব্দুল মালেক তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন-“আমার মনে হয় আজকে যারা এখানে আলোচনা করেছেন তাদের পক্ষ থেকে অনেকগুলো অযৌক্তিক বিষয়ের অবতারণাও করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে common set of cultural values বলতে হয়তো কেউ বুঝেছেন One set of cultural values কিন্তু তাদের এটা মনে রাখা দরকার যে, common set of cultural values মানে One set of cultural values নয়।
আসলে শিক্ষার উদ্দেশ্য কি? শুধুমাত্র মহাকবি Milton- এর একটা কথা আলোচনা করতে চাই। Milton বলেছিলেন, Education is the harmonious development of body, mind and soul. এই body, mind and soul-এর harmonious development কোন Ideology বা কোন আদর্শ ছাড়া কি করে হতে পারে- যারা Ideological শিক্ষা ব্যবস্থা চান না তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা।
Milton- এর এই সংজ্ঞাকে সামনে রেখে আমরা যদি দেখি, তবে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তি চেতনা এবং সঠিক ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করার মাধ্যমে জাতীয় চেতনা ও জাতীয় মতের সৃষ্টি করা। আর যারা শিক্ষার্থী রয়েছেন তাদের mental, physical এবং moral training দিয়ে তাদেরকে এমন একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাতে করে তারা ভবিষ্যতে জনসমষ্টির সাথে একটি common cultural এবং Ideological basis- এর bridge তৈরি করতে পারে এবং এরপর এখানকার যে আদর্শ রয়েছে সেটা যাতে ধীরে ধীরে ভবিষ্যতে increase হতে পারে।
তিনি বলেন-”ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থার যারা প্রবক্তা তারা আজ পাশ্চাত্য সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখুন যে, পাশ্চাত্য সমাজে Liberal education-এর নাম দিয়ে যে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে সে ব্যবস্থায় শিক্ষিত আমেরিকার একজন Social Philosopher এবং Educationist নিজেই বলেছেন যে, Social Philosopher এবং Educationist নিজেই বলেছেন যে, “Three kinds of progress are significant : progress in knowledge and technology, progress in socialization of man and progress in Spirituality. The last one is the most important”
তিনি বর্তমান আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থা Secular এবং Liberal শিক্ষা ব্যবস্থা যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সেখানে একটা turning point-এ শিক্ষাকে Ideologically orient করার চেষ্টা করতে বলেছেন। এই ক্ষেত্রে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন Our age must achieve spicitual renewal. A newren aissance must come- the renaissance in which mankind discovered that ethical action is the supreme truth and the supreme utilitarianism by which mankind will be liberated.” এই Spiritual liberation ছাড়া Mankind-এর কোন Liberation হতে পারে না”।
আজ এই শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের সমাজে এমন কতগুলো ম্যাকলের Brain child এবং Brown English man তৈরি করেছে- যাদের মুখ থেকে আমরা ধর্মহীন শিক্ষার কথা শুনছি। কিন্তু জেনে রাখা দরকার, এ শিক্ষাব্যবস্থা যখন প্রবর্তন করা হয় আজ থেকে দেড়শ বছর আগে এবং যখন এই শিক্ষাব্যবস্থা fail করলো মুসলমানদের মধ্যে তখন Sir William Hunter-কে এর Assessment করতে দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছেন, “The truth is that our system of public instruction is opposed to the tradition, unsuited to the requirements and hateful to the religion of Mussalman.”
যারা বলেন যে, ইসলামের Ideology কি তাদেরকে আমি বলবো যে, আপনি ইসলামের ইতিহাসের উপর পর্যালোচনা করুন। ইসলামের ইতিহাস দেখে তারপরে বলুন ইসলামের Ideology কি। ইসলামের Ideology বা ইসলামের Culture-এর ভিত্তিতে যে সমাজ এবং Society গড়ে উঠেছিল, সেখানে স্থানীয় Culture বা স্থানীয় সংস্কৃতিরও দাম ছিল এবং সেসব বিকশিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল”।
মূলত ইংরেজরা সুকৌশলে চিন্তার বিভ্রান্তি ও বিভাজন সৃষ্টির জন্যই সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা এই দুই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে গিয়েছিল। পাকিস্তান আমল পরবতী কোন শিক্ষা কমিশনের কোনো রিপোর্টে জাতীয় আদর্শ ইসলামের প্রতিফলন ঘটেনি। পক্ষান্তরে সেক্যুলার, নাস্তিক্যবাদী ও ধর্মবিমুখ সমাজতন্ত্রীরা মুসলিম জাতিসত্তার বিলোপ সাধন করে সেক্যুলারিজম বা ধর্মহীনতা চাপিয়ে দেয়ার জন্য সর্বাত্নক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সে ষড়যন্ত্রই এখন বাস্তবায়ন করছে বর্তমান সরকার।
মূলত ইংরেজরা সুকৌশলে চিন্তার বিভ্রান্তি ও বিভাজন সৃষ্টির জন্যই সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা এই দুই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে গিয়েছিল। পাকিস্তান আমল পরবতী কোন শিক্ষা কমিশনের কোনো রিপোর্টে জাতীয় আদর্শ ইসলামের প্রতিফলন ঘটেনি। পক্ষান্তরে সেক্যুলার, নাস্তিক্যবাদী ও ধর্মবিমুখ সমাজতন্ত্রীরা মুসলিম জাতিসত্তার বিলোপ সাধন করে সেক্যুলারিজম বা ধর্মহীনতা চাপিয়ে দেয়ার জন্য সর্বাত্নক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সে ষড়যন্ত্রই এখন বাস্তবায়ন করছে বর্তমান সরকার।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ মাত্র কয়েক মিনিটের বক্তব্যে শহীদ আবদুল মালেকের মেধা, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বক্তব্য বাম-রামদের তখত তাউসকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, একটি উন্নত নৈতিক চরিত্র সম্পন্ন যুব -ছাত্রসমাজ ছাড়া একটি জাতির এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। শহীদ আবদুল মালেকের প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের সে উপলব্ধি আজকের বাস্তবতা। তিনি শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াপত্তনের ভিত্তি আবিষ্কার করেছেন, সে লড়াইয়ে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের প্রাণ। সে কারণে দেশ-জাতি শহীদ আবদুল মালেকের নিকট ঋণী হয়ে থাকবে। স্ব-মহিমায় অবিভূত এ কীর্তিমান নক্ষত্র তাই আজো সমানভাবে জাগরুক প্রতিটি হৃদয়ে। তাঁর অসামান্য কর্ম প্রেরণা আমাদের আন্দোলিত করছে দূরন্ত গতিতে। একজন মানুষ এ ভূবনে স্ব-মহিমায়, জ্ঞানে, ধ্যানে, চিন্তা-চেতনা-কর্মে কত উজ্জ্বল ভাস্বর হতে পারে শহীদ আবদুল মালেক তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে অনাগত পৃথিবীর কাছে। শহীদ আবদুল মালেক ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক, বীর সেনানী। শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর মধ্যে দিয়ে জাতির মেরুদ- শক্তিশালী করার বিনির্মাতাদের অন্যতম।
বিশেষ করে আজ আধুনিকতার নামে নব্য জাহিলিয়াতের যাতাকলে পিষ্ট তরুণ প্রজন্মকে শহীদ আবদুল মালেক দিয়েছেন এক অনন্য পথের দিশা। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে শহীদ আবদুল মালেক একটি প্রেরণা, একটি বিশ্বাস, একটি আন্দোলন, একটি ইতিহাস, একটি মাইলস্টোন। শহীদ আবদুল মালেককে হত্যা করে ইসলামী আদর্শকে স্তদ্ধ করা যায়নি। বরং এক মালেকের রক্ত বাংলার ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে ছড়িয়ে একটি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। লক্ষ-কোটি মালেক আজ একই আদর্শের ছায়াতলে সমবেত। সুতরাং শহীদ আবদুল মালেকের খুনীরা আজ অভিশপ্ত, ঘৃণিত এবং পরাজিত। জাতি তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আবদুল মালেক শহীদ তাঁর জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে সেই পরীক্ষাই দিয়ে গেছেন। সারাটা জীবন কষ্ট করেছেন। আর্থিকভাবে খুবই অসচ্ছল একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বগুড়া জেলায় এই ক্ষণজন্মা নক্ষত্র আবির্ভূত হয়েছিল। জীবন যাপনের অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকেও তিনি ছিলেন বঞ্চিত। কিন্তু তিনি ছিলেন মোহমুক্ত। সেই কচি বয়সে তাঁর মায়ের কোলে থাকার পরিবর্তে তিনি বাড়ি থেকে অনেক দূরে লজিং থেকেছেন। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে আর সাতরিয়ে স্কুলে যেতে হয়েছে তাঁকে। ক্ষুধার যন্ত্রণা, অমানুষিক পরিশ্রম কিংবা দুঃখ-কষ্টের দিনযাপন কোনো কিছুই পিচ্ছিল করতে পারেনি তাঁর চলার পথ। “অহংকার হচ্ছে আল্লাহর চাদর” প্রিয়নবী (সা.) এই হাদীসের বাস্তব উদাহরণ ছিলেন শহীদ আবদুল মালেক।
তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও মনের দিক থেকে ছিলেন একেবারেই নিরহংকার।
এসএসসি ও এইচএসসিতে মেধা তালিকায় স্থান আর ঢাবি সেরা ছাত্রের পোশাক বলতে ছিল একটি কমদামী সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবী। যাতে ইস্ত্রির দাগ কেউ কখনো দেখেছে বলে জানা যায় না। শহীদ আবদুল মালেক প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তাঁর কর্মীদের। সে ভালোবাসা ছিল নিখাদ নিঃস্বার্থ।
এসএসসি ও এইচএসসিতে মেধা তালিকায় স্থান আর ঢাবি সেরা ছাত্রের পোশাক বলতে ছিল একটি কমদামী সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবী। যাতে ইস্ত্রির দাগ কেউ কখনো দেখেছে বলে জানা যায় না। শহীদ আবদুল মালেক প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তাঁর কর্মীদের। সে ভালোবাসা ছিল নিখাদ নিঃস্বার্থ।
জনাব ইবনে মাসুম লিখেছেন : “তিনি ছিলেন তাদের দুঃখ-বেদনার সাথী। তাঁর এই আন্তরিকতার জন্য অনেক কর্মীর কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকের মতো। কর্মীর যোগ্যতাকে সামনে রেখে উপদেশ দিতেন, অনুপ্রেরণা যোগাতেন প্রতিভা বিকাশে। ভাবতে অবাক লাগে, প্রতিটি কর্মী সম্পর্কে তিনি নোট রাখতেন।” মালেক ভাই হয়ত কাজ করছেন, সময় পেলে পড়ছেন। এরপর আন্দোলনের কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছুটে চলেছেন। রাতে হয়তো পোস্টারও লাগাচ্ছেন কর্মীদের সাথে। আবার অনেক সময় পোস্টার লাগাবার পর অন্যান্যদের কাজ শেষ করার পূর্ব পর্যন্ত একটু সময় পেতেন, তখন সিঁড়িতে ঠেস দিয়ে অথবা পীচঢালা নির্জন পথে একটু বসে বিশ্রাম নিতেন।”
নূর মুহাম্মদ মল্লিক লিখেছেন,- “সারাদিন কাজ করে রাতের বেলায় তাঁর নিজের হাতে ক্লান্ত শরীরে সেই একমাত্র পাজামা ও পাঞ্জাবী ধোয়া রুটিন কাজের কথা। কোনো এক রাতে সেটি ধোয়া সম্ভব হয়নি বলে সকালে ধোয়া পাঞ্জাবী আধা ভেজা অবস্থায় গায়ে জড়িয়ে মালেক ভাই গিয়েছিলেন মজলিসে শূরার বৈঠকে যোগ দিতে। মালেক ভাইয়ের পোশাক যেমন সাধাসিধে ছিল, দিলটাও তেমন সাধাসিধে শুভ্র মুক্তার মত ছিল। প্রাণখোলা ব্যবহার তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।” প্রতিকূল পরিবেশকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা নেতৃত্বের যোগ্যতার অন্যতম উপাদান। আর প্রতিকূলতাকে জয় করার নামই তো আন্দোলন। এই কাজের জন্য চাই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। শহীদ আবদুল মালেক ছিলেন তার জীবন্ত ইতিহাস। তাঁর অসাধারণ কর্মকান্ডের তুলনা যেন তিনি নিজেই।
ভাষা সৈনিক মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম লিখেছেন- “শহীদ আবদুল মালেক তরুণ বয়সেই এমন এক উজ্জ্বল নজির রেখে গেছেন যা এদেশে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে চিরদিন প্রেরণা যোগাবে। এতগুলো গুণ একজন ছাত্রের মধ্যে এক সাথে থাকা অত্যন্ত বিরল। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষক ও ছাত্র মহলে তাঁর সুখ্যাতি সত্ত্বেও তাঁর নিকট ছাত্রজীবন থেকে আন্দোলনের জীবনই বেশী প্রিয় ছিল। যথাসম্ভব নিয়মিত ক্লাসে হাজির হওয়াই যেন তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল।
পরীক্ষায় ভাল করার জন্য তাঁর মধ্যে কোনো ব্যস্ততা ছিলনা। ওটা যেন অতি সহজ ব্যাপার ছিল। ক্লাসের বাইরে তাঁকে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো চিন্তাধারা বা আলাপ-আলোচনা করতে বড় একটা দেখা যেত না। তার সহপাঠী ও সহকর্মীরা তাকে পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করার দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিলে মৃদু হেসে বলতেন, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ডিগ্রি নিতে হবে যাতে আয়-রোজগারের একটা পথ হয়। কিন্তু ওটাকে জীবনের চরম লক্ষ্য বানিয়ে নিতে চাই না। খুব ভাল রেজাল্টের ধান্ধা করলে ক্যারিয়ার গড়ে তুলবার নেশায় পেয়ে বসবার আশঙ্কা আছে।
আবদুল মালেকের শাহাদাত আর পরবর্তী শাহাদাতের তুলনা করলে এটাই দেখি একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদাতের ফলে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়া পরবর্তীদের ক্ষেত্রে হয়নি। আন্দোলন যখন শক্তি সঞ্চয় করেছে মাত্র তখন একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদাত আন্দোলনের শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।”
১৯৬৯ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘের এ সাংগঠনিক ক্রান্তিকালে শহীদ আবদুল মালেকের ভূমিকা সম্পর্কে শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, “ঢাকা এবং পূর্ব-পাক সংগঠনের নেতৃত্বকে দূর্বল এবং অসহায় মনে করে সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্থ করার মানসে কিছু সংখ্যক অ-কর্মী কর্মী সেজে এ অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে এগুলো দমন করার জন্য যখন দায়িত্বশীল কর্মীদের রাজী করাতে পারিনি, তখন দায়িত্ব ছেড়ে সরে পড়ার মনোভাব আমার প্রবল হয়েছিল। ‘আমার হাতে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আগে আমি সরে পড়ি, তারপর যাদের উপর দায়িত্ব আসবে তারা পারলে সংগঠনকে বাঁচাবে নতুবা নিজেরাই দায়ী হবে’ এমন বাজে চিন্তা আমার মধ্যে একাধিকবার এসেছে। সংগঠন জীবনে এ ছিল আমার সবচেয়ে দূর্বল মুহুর্ত। আবদুল মালেকের একক হস্তক্ষেপে সেদিন দরবেশী কায়দায় এহেন শয়তানী ওয়াসওয়াসা থেকে আমি রক্ষা পেয়েছিলাম।”
শহীদ আবদুল মালেক ছিলন একটি চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া। জানতে হলে পড়তে হয়। অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই। শহীদ আবদুুল মালেক এ বিষয়ে আমাদের সকলের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। আন্দোলনী কর্মকান্ডের শত ব্যস্ততা মালেক ভাইয়ের জ্ঞানার্জনের পথে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি আর্থিক সঙ্কট সত্ত্বেও তিনি নাস্তার পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতেন, সংগঠনের এয়ানত দিতেন। অথচ তাঁর রেখে যাওয়া এই দেশের ইসলামী আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা কর্মীই এক্ষেত্রে দুঃখজনকভাবে পিছিয়ে আছেন।
শ্রদ্ধেয় কৃতী শিক্ষাবিদ ড. কাজী দীন মুহাম্মদ-এর স্মৃতিচারণ থেকে আমরা জানতে পারি, শত ব্যস্ততার মাঝেও জ্ঞানপিপাসু আব্দুল মালেক দীন মুহম্মদ স্যারের কাছে মাঝে মধ্যেই ছুটে যেতেন জ্ঞানের অন্বেষায়। ইসলামী আন্দোলন করতে হলে নানা বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হয়। কুরআন- হাদীস, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং-বীমা, সমাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি।
মরহুম আব্বাস আলী খান এ প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে বলেন : “বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর পাকা হাতের লেখা পড়তাম মাসিক পৃথিবীতে। বয়স তখন তাঁর উনিশ-বিশ বছর। একেবারে নওজোয়ান। কিন্তু তাঁর লেখার ভাষা ও ভঙ্গী বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর তীক্ষ্ণ ও গভীর জ্ঞান তাঁর প্রতি এক আকর্ষণ সৃষ্টি করে।”
শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জমান লিখেছেন- রাতে ঘুমানোর আগে দেখতাম মালেক ভাই ইংরেজি একটি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছেন। আবার কিছু কিছু নোট করছেন। তিনি মাসিক পৃথিবীতে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতির উপর লিখতেন। বুঝলাম সেই লেখার জন্য মালেক ভাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তখন থেকেই বিদেশী ম্যাগাজিন পড়ার ব্যাপারে আমার মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। মালেক ভাইয়ের অনেক স্মৃতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়”।
যুগে-যুগে নবী-রাসূল (সা.) সাহাবায়ে আজমাইন, আর সত্যপথের পথিকদের যে কারণে বাতিলরা হত্যা ঠিক একই কারণে শহীদ আবদুল মালেক, শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সহ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু শহীদেরা সারা পৃথিবীর মানুষের প্রেরণা। তারা মরেও অমর। তারা এক অনন্য জীবনের সন্ধান পেয়েছে, সেই অনন্ত জীবনের নাম শাহাদাত।
শহীদ আবদুল মালেক চিঠিতে স্পষ্ট করে সেই নিঃস্বার্থ ও নির্মোহ সিদ্ধান্তের কথাই জানিয়েছেন,“বাইরের পৃথিবীতে যেমন দ্বন্দ্ব চলছে তেমনি আমার মনের মধ্যেও চলছে নিরন্তর সংঘাত। আমার জগতে আমার জীবনে আমি খুঁজে নিতে চাই এক কঠিন পথ, জীবন-মরণের পথ। মায়ের বন্ধন ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। বৃহত্তর কল্যাণের পথে সে বন্ধনকে ছিঁড়তে হবে। কঠিন শপথ নিয়ে আমার পথে আমি চলতে চাই। আশির্বাদ করবেন। সত্য প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে যেন আমার জীবনকে আমি শহীদ করে দিতে পারি। আমার মা এবং ভাইয়েরা আশা করে আছেন আমি একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছি। কিন্তু মিথ্যা সে সব আশা। আমি বড় হতে চাইনে, আমি ছোট থেকেই সার্থকতা পেতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হয়ে বিলেত ফিরে যদি বাতিলপন্থীদের পিছনে ছুটতে হয় তবে তাতে কি লাভ?
শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদাতী তামান্নার তীব্রতা প্রতিধ্বনিত হয়েছে সাবেক লজিং মাস্টার জনাব মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে লেখা চিঠির ভাষায়- “জানি, আমার কোনো দুঃসংবাদ শুনলে মা কাঁদবেন। কিন্তু উপায় কি বলুন? বিশ্বের সমস্ত শক্তি আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানকে দেয়া জীবন বিধানকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আমরা মুসলমান যুবকরা বেঁচে থাকতে তা হতে পারে না। হয় বাতিলের উৎখাত করে সত্যের প্রতিষ্ঠা করবো, নচেৎ সে চেষ্টায় আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আপনারা আমায় প্রাণভরে আশির্বাদ করুন, জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও যেন বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি। কারাগারের নিরন্দ্র অন্ধকার, সরকারি যাঁতাকলের নিষ্পেষণ আর ফাঁসির মঞ্চও যেন আমাকে ভড়কে দিতে না পারে।”
জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের বিদায়ে কেঁদেছে গোটা জাতি। দলমত নির্বিশেষে সবাই এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সে সময়ের সংবাদ পত্র তার সাক্ষী। শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল জাতীয় নেতারা নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছিল। আওলাদে রাসুল শহীদ আবদুল মালেকের জানাজার পূর্বে আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে বলেছিল- “শহীদ আবদুল মালেকের পরিবর্তে আল্লাহ যদি আমাকে শহীদ করতেন তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। শহীদ আবদুল মালেকের হত্যাকারীদের বিচার এখনো হয়নি। এই দুনিয়ার আদালতে তাদের বিচার না হলেও আল্লাহর আদালত থেকে তারা রেহাই পাবেনা এটাই আমাদের বিশ্বাস। শহীদ আবদুল মালেকের খুনীরা অনেকেই এখন রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অধিষ্ঠিত। শহীদ আবদুল মালেক সকল হত্যার বদলা তাঁর উত্তরসূরীরা এই জমিনে কালেমার পতাকা উড্ডীন করার মাধ্যমে গ্রহণ করবে, ইনশাআল্লাহ। হে! আরশের মালিক, শহীদ আবদুল মালেকসহ সকল শহীদদেরকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমীন।
No comments:
Post a Comment